অপরাধের নতুন জগৎ: লকডাউনের প্রভাব
কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় মানুষের অনলাইন নির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাইবার অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভয় এবং অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে তারা নতুন নতুন প্রতারণার জাল তৈরি করে, যা সাইবার অপরাধের সংখ্যাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে ২০২০ পরবর্তী সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির হার (আনুমানিক)
অপরাধীর অস্ত্রাগার: যেভাবে পাতা হয় প্রতারণার ফাঁদ
বাংলাদেশে প্রচলিত সাইবার অপরাধ
MFS ও ব্যাংকিং প্রতারণা: প্রতারকরা কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি সেজে ফোন দিয়ে বা লটারি জেতার লোভ দেখিয়ে আপনার পিন (PIN) বা ওটিপি (OTP) জেনে নেয় এবং মুহূর্তেই অ্যাকাউন্ট খালি করে ফেলে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্ল্যাকমেলিং: প্রথমে নকল প্রোফাইল থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা হয়। এরপর ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল ছবি/তথ্য সংগ্রহ করে তা ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করা হয়।
কর্পোরেট গুপ্তচরবৃত্তি: কোনো কোম্পানির গোপন তথ্য, যেমন— নতুন পণ্যের ডিজাইন বা গ্রাহক তালিকা, চুরি করে প্রতিযোগী সংস্থাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এর জন্য ઘણીવાર স্টেগানোগ্রাফির মতো উন্নত কৌশল ব্যবহার করা হয়।
ফিশিং ও ম্যালওয়্যার: ব্যাংক বা কোনো পরিচিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের মতো হুবহু দেখতে একটি নকল ওয়েবসাইট তৈরি করে আপনাকে পাঠানো হয়। আপনি সেখানে লগইন করলেই আপনার ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড চুরি হয়ে যায়।
কেস স্টাডি: ফ্যান্টম বিকাশ এজেন্ট
একটি বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত।
ঘটনা: সারাদেশে শত শত মানুষ অভিযোগ করে যে তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল না।
তদন্তের মোড়: পুলিশ একটি চক্রের সদস্যকে আটক করে, কিন্তু তার ফোন থেকে সব ডেটা মুছে ফেলা হয়েছিল। ফোনটি দেখতে একদম খালি ছিল।
লুকানো ফাইলের উন্মোচন: ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মুছে ফেলা ডেটা পুনরুদ্ধার করেন। ফোনের একটি লুকানো ফোল্ডারে একটি এনক্রিপ্টেড লেজার ফাইল (.xlsx) পাওয়া যায়।
ফলাফল: সেই লেজার ফাইলে শত শত ভুক্তভোগীর ফোন নম্বর, চুরি করা টাকার পরিমাণ এবং চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে টাকা ভাগের হিসাব ছিল। এই একটি ফাইল থেকেই পুরো দেশব্যাপী প্রতারক চক্রটিকে ধরা সম্ভব হয়।
এই ঘটনাই প্রমাণ করে, "Deleted" মানে "Gone Forever" নয়।
তদন্তকারীর চোখে: ডিজিটাল প্রমাণের খোঁজ
ডিজিটাল প্রমাণের উৎস
অপরাধীরা ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও, তদন্তকারীরা প্রায়শই লুকানো উৎস থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উদ্ধার করেন।
এনক্রিপ্টেড ফাইল: অপরাধীরা ডেটা বিশেষ পাসওয়ার্ড বা কোড দিয়ে লক করে রাখে। ফরেনসিক টুল ব্যবহার করে এই লক ভাঙা হয়।
স্টেগানোগ্রাফি: একটি সাধারণ ছবির পিক্সেলের ভেতরে গোপন বার্তা বা ফাইল লুকিয়ে রাখা হয়, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
মুছে ফেলা ডেটা উদ্ধার: আপনি ফোন বা কম্পিউটার থেকে কিছু ডিলিট করলেও, তার অবশেষ ডিভাইসের মেমরিতে থেকে যায়, যা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
লুকানো পার্টিশন ও ক্লাউড: হার্ডডিস্কের মধ্যে একটি গোপন ড্রাইভ তৈরি করা বা ক্লাউড স্টোরেজে (যেমন Google Drive) ডেটা লুকিয়ে রাখা হয়, যা সাধারণ ব্যবহারকারীরা খুঁজে পায় না।
মানুষ বনাম যন্ত্র: ভবিষ্যতের অপরাধ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ব্লকচেইন এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT)-এর মতো প্রযুক্তির উত্থান সাইবার অপরাধের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
ডিজিটাল বর্ম: যেভাবে সুরক্ষিত থাকবেন
সচেতনতাই সাইবার জগতে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। নিচের অভ্যাসগুলো গড়ে তুলুন।
🔑জটিল পাসওয়ার্ড
করুন: কমপক্ষে ১২ অক্ষরের পাসওয়ার্ড তৈরি করুন যেখানে বড় হাতের অক্ষর (A-Z), ছোট হাতের অক্ষর (a-z), সংখ্যা (0-9) এবং চিহ্ন (@, #, $, %)—সবকিছুর মিশ্রণ থাকে। যেমন: `AmarDesh#2025!`
করবেন না: নিজের নাম, জন্মতারিখ, `123456`, `password`—এই ধরনের সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করবেন না।
🛡️টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA)
করুন: ফেসবুক, জিমেইল, এবং ব্যাংকিং অ্যাপে 2FA অপশনটি চালু করুন। এতে কেউ আপনার পাসওয়ার্ড জেনে গেলেও লগইন করতে পারবে না, কারণ আপনার ফোনে একটি কোড আসবে।
করবেন না: এই অতিরিক্ত সুরক্ষা স্তরটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে এড়িয়ে যাবেন না।
🎣ফিশিং থেকে সতর্কতা
করুন: কোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে তার ওপর মাউস বা আঙুল রেখে আসল ঠিকানাটি দেখে নিন। যেমন, আসল ঠিকানা `bKash.com`, কিন্তু প্রতারকরা `bkash-offer.xyz` ব্যবহার করতে পারে।
করবেন না: লোভনীয় অফার বা পুরস্কার জেতার মেসেজ দেখেই আবেগের বশে অজানা লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
🤫ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার
করুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার ফোন নম্বর, ঠিকানা, বা জন্মতারিখের মতো ব্যক্তিগত তথ্য 'Only Me' বা 'Friends' প্রাইভেসি সেটিং দিয়ে রাখুন।
করবেন না: পাবলিক প্লেসে বা অপরিচিত কারো সাথে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা পাসপোর্টের ছবি শেয়ার করবেন না।